টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের অজানা ইতিহাস

টেলিগ্রাফের টরে টক্কার সঙ্গে আমাদের অনেকেরই পরিচয় আছে। টেলিগ্রাফ লাইনে কান পেতে অনেকেই হয়তো ছেলেবেলায় অনেক কিছু শুনতে চেষ্টা করেছি। বছর বিশেক আগেও আমাদের খবরাখবর আদান-প্রদানে টেলিগ্রাফ অত্যন্ত জরুরী মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হতো। কিভাবে এই টেলিগ্রাফ আবিষ্কৃত হলো? অনেকদিন আগের কথা। আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র পরবর্তীকালে তিনি ইংল্যাণ্ড আমেরিকায় ছবি আঁকিয়ে হিসেবে দারুণ নাম করেছিলেন। তিনি মোটেই বিজ্ঞানী ছিলেন না। অথচ তিনিই টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেছিলেন। মন্ত্রী-পিতার ঘরে ১৭৯১ সালে স্যামুয়েল ফিনলে ব্রিসি মোর্স চালর্স টাউনে জন্মেছিলেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে প্রথম দিকে তিনি কিছুটা অধ্যাপক জেরেমিয়ে ডে'র অধীনে বিদ্যুৎ বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। 

এই অধ্যাপক ডে ছিলেন তখনকার দিনের খুবই নামকরা পদার্থবিদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান তার মূল পাঠ্য বিষয় ছিল না। কিন্তু 'বৈদ্যুতিক প্রবাহ তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে', বিষয়টি যুবক মোর্সকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে তুলেছিল। পরবর্তীকালে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে এভাবে বলেছেন, 'আমার মনে এই বীজ রোপিত হয়ে যায় ক্রমশ তা মহীরুহতে পরিণত হয়, তা আমার মনকে ইউরোপ থেকে ফেরার পর আচ্ছন্ন করে ফেলে। ইংল্যাণ্ডে তিনি সেকালের বড় বড় সব ছবি আঁকিয়েদের সঙ্গে বা গড়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই লণ্ডনের রয়াল একাডেমীতে তার চিত্রাবলী প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৮১৫ সালে তিনি আমেরিকায় ফেরেন, এখানেই তার খ্যাতি ছড়াতে শুরু করে। মোর্স নিউইয়র্ক শহরে নিজের বাড়ী তৈরী করেন, এখানেই তিনি তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে নিউইয়র্ক ড্রয়িং এ্যাসোসিয়েশন তৈরী করেন। তিনিই সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তী দশকে তাঁর ছবি বক্তৃতামালা এত সুনাম বয়ে আনে যে, তিনি ন্যাশনাল গ্যালারীর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।  

টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের কথা

১৮২৯ সালের এই নির্বাচন মোর্সের জন্য ছিল বিরাট সম্মান। এরপরই কিন্তু মোর্সের জীবনে নেমে আসে দারুণ দুর্যোগ। তাঁর স্ত্রী মারা যায়। বিষণ্ণ মোর্স এবার বেরিয়ে পড়েন ইউরোপ পর্যটনে। উদ্দেশ্য ইউরোপীয় শিল্পকলা সম্পর্কে জানা। অশান্ত মনে একে একে ঘুরে বেড়ালেন ফ্লোরেন্স, রোম, প্যারিস। তখনো তার সামান্য ধারণা ছিল না তার ভবিতব্যের চাকা অন্যদিকে ঘুরবে। তিনি ছিলেন শিল্পী, বিজ্ঞানী নন। সন্দেহ হয়, তাঁর কলেজে পড়াকালীন অধ্যাপক ডে'র সঙ্গে ল্যাবরেটরীতে কাজ করার সময় বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর মাথায় আদৌ কোন পরিকল্পনা ছিল কিনা। কারণ পরবর্তী তিনটি বছর তিনি বিশ্বের চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ মাস্টার পিসগুলো দেখে কাটালেন। ততদিনে তার বয়স হয়ে গেছে একচল্লিশ। কিন্তু হঠাৎ করেই তার জীবন বদলে গেল। ১৮৩২ সালের অক্টোবর মাসে সুল্লী নামে একটি ডাকবাহী স্টিমার লে হার্ভে থেকে নিউইয়র্ক যাচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে ছিল ইলেকট্র- মাগনেটিজমের বিখ্যাত ইউরোপীয় বিজ্ঞানী ডঃ জ্যাকসন। লে হার্ভে থেকে জাহাজ ছেড়েছে দিন দুই হলো। রাতের বেলা জাহাজের যাত্রীরা ডঃ জ্যাকসনের বক্তৃতা শুনছিলেন। 

তিনি বলছিলেন ইলেকট্র-ম্যাগনেটের আশ্চর্য সব সম্ভাবনার কথা। সেই সাথে কথায় কথায় এসে পড়ল বিখ্যাত ফরাসী পদার্থবিদ বৈদ্যুতিক তাত্ত্বিক আন্দ্রে এ্যামপেয়ারের কথা। ডঃ জ্যাকসন বিশাল বক্তৃতা দিলেন, বিশেষ করে তারকে গোল করে জড়ানোয় ইলেকট্র-ম্যাগনেটে কি কি সুবিধে হয় সে সম্পর্কে। কয়েলের চারধারে যত তার পেঁচানো হবে, তারের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালালে তারের আশপাশের বিদ্যুৎ প্রবাহ তত শক্তিশালী হবে। একজনের একটি প্রশ্ন তাকে থামিয়ে দিল, পেঁচানো তারের দৈর্ঘ্য প্রবাহিত বিদ্যুতের গতি কমিয়ে দিতে পারে কিনা? ডঃ জ্যাকসন কোন মতে জবাব দিলেন, বিদ্যুৎপ্রবাহ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে চলাচল করে, তারের দৈর্ঘ্যের কিছু আসে যায় না। প্রশ্নকর্তা ছিলেন মোর্স। এবার তিনি বললেন, সার্কিটের কোন অংশে যদি বিদ্যুতের উপস্থিতি চোখে দেখানো যায় তা হলে বিদ্যুতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে খবরাখবর পাঠান যাবে না কেন? কথাবার্তা চলতে লাগল, কিন্তু নতুন ভাবনাটি মোর্সের মাথায় গেঁথে রইল। এখান থেকে মোর্সের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। আর তার সুফল পেল সভ্য জগতের মানুষজন। 

মোর্সের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল 'বিদ্যুৎপ্রবাহ তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে চলে,' 'যদি বিদ্যুৎপ্রবাহ এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে চলে যায়, তবে এর মাধ্যমে খবরাখবর পাঠানো যাবে না কেন? ভাবতে লাগলেন মোর্স। 'বিদ্যুৎপ্রবাহ কোথাও থামিয়ে সেখানে বিদ্যুৎজ্জ্বটা উৎপাদন করা নিশ্চয়ই যাবে।' এই বিদ্যুৎজ্জ্বটাকেই সঙ্কেতে রূপান্তর করা যাবে, বিদ্যুৎজ্জ্বটা বা সম্পর্কের অবর্তমানে একটা সঙ্কেত আর নিশ্চুপ সময়টা আর একটা সঙ্কেত হিসেবে কাজে লাগতে পারে। আর এইসব সঙ্কেতকে একত্রিত করে নতুন ধরনের পদ্ধতির অক্ষর তৈরী করা যেতে পারে। এই চিহ্নগুলো দিয়ে শব্দও বানানো যেতে পারে। এভাবেই দূরের শব্দাবলী ধারণ করার পদ্ধতি টেলিগ্রাফ- মোর্সের মাথায় এলো। মহাদেশ পেরিয়ে, মহাসাগর পেরিয়ে শব্দ ভেসে যাবে। সারা পৃথিবীতেই শব্দ পাঠানো যাবে। এসব চিন্তায় মোর্সের ছবি আঁকার কাজ মাথায় উঠল। অদম্য কর্মশীলতা, উদ্দীপনা উজাড় করে ঢাললেন মোর্স তার নতুন আবিষ্কারের নেশায়। একটি মাত্র লক্ষ্য- আমি এমন যন্ত্র তৈরী করব যাতে পৃথিবীর সব প্রান্তে খবরাখবর পাঠাতে পারব। রাতারাতি তিনি তার পরবর্তী জীবনের কর্মপন্থা ঠিক করে ফেললেন।

জাহাজ চলবার পরের দিনগুলো মোর্স তার কেবিনের দরজা বন্ধ করে কাটালেন। কারও সঙ্গে আড্ডায় বসলেন না। সারাক্ষণ তার নতুন ভাবনাটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। সমস্যাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। জাহাজে কোন যন্ত্রপাতি পাওয়া গেল না। কোন পরীক্ষারও সুযোগ নেই। তবু তার মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেই তিনি বেশ কিছুটা এগিয়ে যান। তার বিজ্ঞানের উপর তেমন দখল ছিল না। এক সময় স্কেচ বুকে আঁকা থাকত মানুষের নানা ধরনের দেহভঙ্গীমা, গাছপালা, পাহাড় পর্বত, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী। আর এখন সেই স্কেচ বুক ভরে উঠল সম্ভাব্য টেলিগ্রাফ যন্ত্রের নানা অংশের হাতে আঁকা ছবিতে। কার্যক্ষম টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করার জন্য মোর্স অমানুষিক পরিশ্রম করে যেতে লাগলেন। তাকে নানা ধরনের বাধা বিপত্তি পোহাতে হলো। অনেক পরিশ্রমী বিজ্ঞানীও এরকম বিপত্তিতে পড়লে হটে যেতেন। মোর্স ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া মানুষ। হতদ্যম হতে জানেন না। 

বিদ্যুৎ-বিজ্ঞান সম্পর্কে তার প্রায় ধারণাই ছিল না বলা চলে। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য যে সব যন্ত্রপাতি চালাতে হয়, সেগুলোও মোর্সের আয়ত্তে নেই। তাকে না জেনেই একটি যন্ত্রের পর আর একটি যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করতে হতো, প্রয়োজনীয় যন্ত্র মেলানোর জন্য। কিন্তু তিনি অনবরত বিফল হতে লাগলেন। তিন বছর এ ভাবে কাটল। হাতের টাকা ফুরিয়ে এলো, অথচ কাজের কিছুই হলো না। এদিকে শিল্পচর্চার কাজ ছেড়ে দেয়ায় শিল্পী হিসেবে একসময় তার যে খ্যাতি গড়ে উঠেছিল, তাও মিলিয়ে যেতে লাগল। ১৮৩৫ সালে নিউইয়র্ক শহরে নিউ ইউনিভার্সিটি তৈরী হয়। মোর্সকে শিল্প ও ডিজাইনের অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের জন্য ডাকা হয়। কাজটি তাকে নিতে হলো। একে হাতে টাকা পয়সা নেই, তার উপর পর পর নিরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে জীবনে কি করা দরকার ভেবে উঠতে পারছিলেন না। নিউ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়ে কিন্তু মোর্স ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে গেলেন। এখানে তার দেখা হলো রসায়ন বিদ্যার অধ্যাপক লেনার্ড গালের সঙ্গে। গালে তাকে অত্যন্ত মূল্যবান পরামর্শ দিতে লাগলেন।

বিশেষ করে তাকে জোসেফ হেনরীর নতুন আবিষ্কার ইলেকট্র-ম্যাগনেট সম্পর্কে পড়াশুনা করার পরামর্শ দিলেন, যন্ত্রটির নির্মাণ শৈলীর বিষয়ে ধারণা নেবার কথা বললেন। মোর্স তাই করল। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে মোর্স সামান্য কার্যক্ষম একটি ছোট ইলেকট্র-ম্যাগনেট যন্ত্র তৈরীও করে ফেললেন। একটি কাঠের টেবিলে ফ্রেম করে মোর্স তার নতুন নির্মিত ইলেকট্র-ম্যাগনেটটি রাখলেন। একটি চুম্বকের উপরে রাখা হলো একটি দোলক। দুলিয়ে দিলে এটা চুম্বকটির সামনে পেছনে দুলতে থাকে। প্রতিবার মোর্স যখনই তার বিদ্যুৎ সারকিটের মাধ্যমে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে দেয় বা থামিয়ে দেয়, চুম্বকটি তখন (বিদ্যুৎ চালানো অবস্থায়) দোলকটিকে টেনে নেয় বা ছেড়ে দেয়। দোলকটির নীচের অংশে পেন্সিল বসিয়ে দিয়েছিল মোর্স। আর পেন্সিলটির নীচে আঠা লাগানো কাগজ দিয়েছিলেন। ফলে দোলকটির নড়াচড়ার সময় কাগজের উপর পেন্সিলের দাগ পড়ে যেত। আঠা লাগানো কাগজটি সরিয়ে সরিয়ে পেন্সিলের দাগগুলো ঠিকমতো দাগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। দোলকটির উপর চুম্বকের প্রভাবের ফলে কাগজের উপর আঁকাবাঁকা দাগ পড়ত। 

এই দাগই অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের মোর্স কোডের বর্ণমালা। কাজ কিছুটা হচ্ছিল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। ব্যাটারী থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎপ্রবাহ অত্যন্ত দূর্বল, তা দিয়ে একটু দূরের কোথাও সংবাদ পাঠানো যায় না। ফলে মোর্সকে ধারাবাহিক ভাবে ব্যাটারী বসাতে হলো। এবার বেশ কিছুটা দূরে সংবাদ পাঠাতে সক্ষম হলেন মোর্স। ইতিমধ্যে মোর্সের বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। গত ছয়টি বছর কাটিয়েছেন পরীক্ষা নিরীক্ষা আর গবেষণা করে। এত সাধ্যসাধনার ফল পেয়েছেন ঝামেলাপূর্ণ একটি যন্ত্র- এ দিয়ে শুধু মানুষকে ধারণাটুকু দেয়া যায় কি করে তারের মাধ্যমে শব্দাবলী দূরে পাঠানো যায়। এত পরিশ্রমের পরও তার কোন সম্পদ হলো না। বলতে গেলে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। আর শিল্পী হিসাবে তার সুনাম এখন অতীত ইতিহাস হয়ে দাঁড়াল। পরিস্থিতি যখন ভয়াবহতায় মোড় নিচ্ছে, এমনি সময়ে মোর্সের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যুবক বয়সী আলফ্রেড ভেইলের সঙ্গে। 

টেলিগ্রাফ আবিষ্কারে ভদ্রলোকের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল; তিনি মোর্সকে উৎসাহ দিতে দুহাজার ডলার দিলেন, বিনিময়ে মোর্সকে তাকে অংশীদার হিসেবে নিতে হলো। মোর্সের এটাই দরকার ছিল। আবার পূর্ণোদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মোর্স। সঙ্গী ভেইলের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি চালানোর যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও কাজে লাগল। উভয়ের অদম্য উৎসাহ পরিশ্রমে ১৮৩৮ সালে কার্যক্ষম টেলিগ্রাফ যন্ত্র তৈরী হয়ে গেল, আর যন্ত্রটি সে বছরই জানুয়ারি মাসে জনসাধারণের সামনে দেখানো হলো। পরের বছরগুলো মোর্স এবং ভেইল মিলে টেলিগ্রাফ যন্ত্রের অনেক উন্নতি সাধন করলেন। তারা পেণ্ডুলাম বাদ দিলেন, পেন্সিলের যে আঁকাবাঁকা দাগ কোড হিসেবে কাজ করত, তার বদলে বিখ্যাত মোর্সের ডট ও ড্যাসের কোড চালু করলেন। ফলে টেলিগ্রাফে প্রাপ্ত খবরাখবর অনুবাদে সুবিধে হলো। শক্তিশালী ব্যাটারীর মাধ্যমে সংবাদ রিলে করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হলো। ফলে মাইল মাইল দূরেও খবর পাঠানো গেল। 

এবার সত্যিকারের কার্যক্ষম টেলিগ্রাফের জন্ম হলো। কিন্তু কাউকে উৎসাহী করা গেল না। কেইবা এরকম অবাস্তব খেলনার পেছনে টাকা ঢালবেন। উৎসাহ না হারিয়ে মোর্স যন্ত্রপাতি নিয়ে ওয়াশিংটন গেলেন; যন্ত্রটির বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতার কথা অনেক জনকে বোঝালেন। তাদের কথায় আশান্বিত হয়ে কংগ্রেসে ৩০ হাজার ডলারের একটি বিল উত্থাপন করা হলো। মোর্স ও ভেইল মিলে ওয়াশিংটন ও বাল্টিমোরের মধ্যে একটি পরীক্ষাধর্মী টেলিগ্রাফ লাইন চালুর জন্য বিলটি তোলার ব্যবস্থা করলেন। নিজের সাফল্যে আশান্বিত হয়ে মোর্স ইউরোপ সফর করলেন। উদ্দেশ্য যন্ত্রটি ইউরোপে চালানোর উপযোগী ক্রেতা খুঁজে বের করা। কিন্তু কেউই তাকে আশা দিলেন না। 

পরের বছর নিউইয়র্কে ফিরে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। সেই যে ডঃ জ্যাকসন যার সঙ্গে অনেক বছর আগে সুল্লি জাহাজে মোর্সের পরিচয় হয়েছিল। যার কাছ থেকে তার মাথায় ইলেকট্র-ম্যাগনেট ঢুকেছিল, সেই জ্যাকসন মোর্সের কাছে তার আবিষ্কারের ভাগ দাবী করে বসলেন। শুধু তাই নয় তার ইউরোপ ভ্রমণের সময়টাতে কংগ্রেসও চুপ মেরে গেল। এ সময়টা মোর্সের জীবনে সবচেয়ে সংকটের। কংগ্রেসের ব্যাপারটি এখন তামাদি হয়ে গেল। ওদিকে ডঃ জ্যাকসন চাইছেন অর্ধেক শেয়ার। মোর্সের জীবন টাকা পয়সার অভাবে দুর্বিসহ হয়ে পড়ল, এমনকি তাকে না খেয়েও কাটাতে হলো। এভাবে চলল ভয়াবহ এক বছর। কেউ এগিয়ে এলো না সাহায্য করতে। কোন ধরনের জীবিকার ব্যবস্থাও হলো না। অবশেষে ১৮৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী তারিখে ৬০ হাজার ডলারের বিলটি আবার কংগ্রেসে তোলা হলো। 

কংগ্রেসে বাদানুবাদ চলল, অনেকে পাগলামী বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। শেষে মাত্র আট ভোটে প্রস্তাব পাশ হলো। যা হোক সাফল্য এলো। মোর্স আর ভেইল মিলে ওয়াশিংটন বাল্টিমোরের মধ্যে টেলিগ্রাফ লাইন তৈরীতে নেমে পড়লেন। কিন্তু তারা বোকার মতো একটা কাজ করে ফেললেন। লাইনটি তারা মাটির নীচ দিয়ে স্থাপন করলেন। ত্রিশ বছর পর তারা কাজটি করলে অবশ্য ক্ষতি হতো না। কিন্তু তখনকার দিনে তারের উপর ভাল ইনসুলেসন বসানো যেত না, ফলে দূর্বল ইনসুলেসন সহ তার বসানোয় তাদের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। এর মধ্যেই বরাদ্দ টাকার দুই তৃতীয়াংশ ব্যয় হয়ে গেছে, অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আবার নতুন করে কাজ শুরু করতে হলো। 

এবার তারা একশো ফিট দূরে দূরে টেলিগ্রাফের থাম বসালেন। প্রতিটি থামের মাথায় আড়াআড়ি পাত বসিয়ে তার উপর দিয়ে টেলিগ্রাফের তার বসালেন। পাত ও তারের সংযোগে বসালেন কাঁচের বোতল ইনসুলেটর হিসেবে। ১৮৪৪ সালের বসন্তকালে লাইন বসানোর কাজ শেষ হলো। অবশেষে এলো সেই মহান দিন ১৮৪৪ সালের ২৪শে মে জনসাধারণের সামনে তাদের আবিষ্কার দেখানোর জন্য সবাইকে ডাকলেন মোর্স ও ভেইল। মোর্স রইলেন ওয়াশিংটনে, ভেইলকে পাঠালেন বাল্টিমোর। ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমোরে পৃথিবীতে তারের মধ্যে দিয়ে এক সেকেণ্ডের ৪৫ হাজার ভাগের একভাগ সময়ে খবর পাঠানো হলো। প্রথম সংবাদটি ছিল, What hath God Wrought?

কিন্তু হাজার হাজার প্রত্যক্ষদর্শীরা বিষয়টিতে নির্বিকার রইলেন। তাদের কাছে এই ধরনের খবর আদান-প্রদান মোটেই আশাপ্রদ নয়, অনেকে তো সরাসরি জানালেন এর মধ্যে কোন জালিয়াতি আছে। কিন্তু পরিস্থিতি অভাবিত পথে পাল্টে গেল। সেসময় বাল্টিমোরে ডেমক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনসনের অধিবেশন বসার কথা ২৪শে মে তারিখে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেমস কে পোল্ক এর মনোনয়ন পাওয়ার কথা থাকলেও হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে তার মনোনয়ন হয়। ফলে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ খালি হয়ে যায়; একজনকে মনোনয়ন দেয়া আবশ্যিক হয়ে পড়ে। এই পদে ডেলিগেটরা নিউইয়র্কের সিনেটর সাইলাস রাইটকে মনোনয়ন দেন। খবরটি ভেইল পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি টেলিগ্রাফ করে খবরটি ওয়াশিংটনে মোর্সকে পাঠিয়ে দেন। মোর্স টেলিগ্রাফটি রাইটের কাছে নিয়ে যান। রাইট পদটি চাননি। তিনি অস্বীকৃতি জানালে পাল্টা টেলিগ্রাফে মোর্স ভেইলকে রাইটের মনোভাব জানালেন। এই সংবাদ আবার ভেইল নিয়ে বাল্টিমোর কনভেনসনের ডেলিগেটদের দেখালেন। কিন্তু তারা এর একটি শব্দও বিশ্বাস করলেন না। টেলিগ্রাফের ব্যাপারটি সত্য কিনা তা জানবার জন্য নিউইয়র্কে একটি কমিটি পাঠানো হয়, তারা সংবাদটির সত্যতা পেয়ে দারুণ আলোড়িত হন। এরপর সমস্ত আমেরিকা এই বিস্ময়কর আবিষ্কারকে সাদরে গ্রহণ করে।

আর্টিকেল টি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন
পরবর্তী প্রবন্ধ পূর্ববর্তী প্রবন্ধ
মন্তব্য নেই
মন্তব্য করুন
comment url