বাঁকানো কাঁচ আবিষ্কারের ইতিহাস

বাঁকানো কাঁচ আজকের পৃথিবীর মানুষের জীবন রক্ষায় বাঁকানো কাঁচের অসাধারণ ভূমিকা আমরা হয়তো সবসময় চিন্তা করতে পারি না। কয়েক কোটি লোকের জীবন যে এই বাঁকানো কাঁচের সাহায্যে বাঁচানো হয়, একটু চিন্তা করলেই বিষয়টি আমাদের মাথায় আসবে। একটু ভালভাবে পৃথিবীকে দেখবার জন্য কোটি কোটি মানুষ চোখে চশমা পড়ে। বাঁকানো কাঁচ, যাকে আমরা লেন্স বলি, সেটা না আবিষ্কৃত হলে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার সম্ভব হতো না। ফলে অপটিকস বিজ্ঞান অথবা জীবানু বিজ্ঞান সম্বন্ধে মানুষ জানত না। ফলে প্লেগ বা মহামারীর হাতে মানব সভ্যতাই বিপন্ন হয়ে পড়ত। ফটোগ্রাফীও আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম না, কোটি কোটি মানুষই হয়তো জানতাম না পরিষ্কার দৃষ্টিশক্তি কাকে বলে। 

নৌ চলাচলে, জরীপের কাজে টেলিস্কোপ প্রভৃতিতে প্রধান উপাদান হলো বাঁকানো কাঁচ। এত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় যে লেন্স, কে এই মহাউপকারী বস্তুটি আবিষ্কার করেছে- এটা অনেকেরই প্রশ্ন হতে পারে। দুঃখের বিষয় এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বিশেষ কিছু জানা যায় না। একক কৃতিত্ব কেউ দাবী করতে পারেন না। প্রাচীন পৃথিবীর মানুষদের কাছে কাঁচের পিণ্ড দিয়ে বড় করে দেখা যায়, এটা জানা ছিল। শিলা স্ফটিকের একধরনের অমার্জিত লেন্স নিনেভের প্রাচীন ধ্বংশস্তুপে পাওয়া গেছে। তবে এগুলো এত অমার্জিত যে মনে হয় না এগুলো কোন কাজে লাগানো হয়েছিল। 

বাঁকানো কাঁচ আবিষ্কারের ইতিহাস

ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনিই প্রথম দেখালেন রগের ভিতর দিয়ে রক্ত ফুসফুসের নানা তন্ত্রীতে ছড়িয়ে পড়ছে, তিনিই প্রথম দেখালেন কিভাবে মানুষের শরীরে ফুসফুস যন্ত্রটি কাজ করে। এত কাণ্ডের পরও অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে সেকালে মানুষের আগ্রহ ততটা দেখা যায়নি। তখনকার দিনে ক্ষুদ্র বস্তু মানুষের কি উপকারে আসবে সেটা ভাববার মতো লোকজন ছিল না। এ্যান্টন ভ্যান লিউওয়েনহোয়েক নামের এক ডাচ বিজ্ঞানী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের গুরুত্ব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেন। তিনি সৃষ্টি করলেন জীবানুতত্ত্বের বিজ্ঞান। তাকে ব্যাকটেরিয়োলজির পিতা হিসেবে স্বীকৃত দেয়া হয়। লিউওয়েনহোয়েক বৃষ্টির জলের ফোঁটার মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ দেখতে পেলেন। 

১৬৮৩ সালে প্রথমবারের মতো তিনি এই ক্ষুদ্র প্রাণের ছবি এঁকে আমস্টারডামের রয়াল সোসাইটিতে পাঠালেন। ১১০ পৃষ্ঠা তিনি সোসাইটিতে পাঠিয়েছিলেন, ২৭ পৃষ্ঠা পাঠালেন ফরাসী একাডেমীতে। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের দেখা শত শত ক্ষুদ্র প্রাণের ছবি তিনি পাঠিয়ে ছিলেন। এগুলো সে সময়ের বিজ্ঞানীদের চিন্তায় দারুণ আলোড়ন আনে, পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরাও এগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। এতসব কাণ্ড ঘটল মাইক্রোস্কোপকে ঘিরে। এই যন্ত্রের গুরুত্ব এত সুদূরপ্রসারী যে, আজও এই যন্ত্রের ব্যবহার সমানতালে চলছে। ফলে পৃথিবীর মহান আবিষ্কারের মধ্যে অনুবীক্ষণ অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে। নিজের কাজের কথা চিন্তা করে লিউওয়েনহোয়েক নানা ধরনের অনুবীক্ষণ যন্ত্র বানাতেন। ২২৭টি যন্ত্র তিনি বানিয়েছিলেন। প্রতিটি বই নিজস্ব কিছু গুণাগুণ ছিল। তবে প্রত্যেকটি যন্ত্রই অত্যন্ত সাদামাটাভাবে তৈরী ছিল। 

১৭২৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল তিনি ৪১৯ টি লেন্সের নক্সা করে রেখে গিয়েছিলেন। এদের অধিকাংশই উভয় পাশের উত্তল লেন্স। এগুলো পরবর্তীকালে ফটোগ্রাফীতে, সিনেমার প্রজেক্টরের বল ব্যবহার করা হচ্ছে। এই মহান ধৈর্যশীল ব্যক্তিটির জন্য কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা সম্ভব হচ্ছে, প্লেগের মরণ ছোবল ঠেকানো গেছে, অনেক মহামারী যেমন কলেরা বসন্ত প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তিনিই প্রথম আমাদের কার্যোপযোগী লেন্স দিলেন। লিউওয়েনহোয়েক লেন্সের গুরুত্ব বোঝাতে পারলেও এর বিশাল প্রয়োগ তখনো ততটা গুরুত্ব পায়নি। বিভিন্ন যন্ত্রে লেন্সের ব্যবহার জানতে বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। অপেক্ষা করতে হয়েছে অপটিকস বিজ্ঞানের বিকাশের উপর, অপেক্ষা করতে হয়েছে হাইজেনশস-এর মতো অগ্রদূতের জন্য। প্রতিভাবান এই বৈজ্ঞানিক হাইজেনস খুব অল্প বয়স থেকেই অঙ্ক ও বিজ্ঞানের অত্যন্ত অনুরাগী ছাত্র ছিলেন। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি দোলক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। লেন্স ঘষা, কাটা, মসৃণ করার জন্য নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তার পদ্ধতি এখন পর্যন্ত ব্যবহার হয়ে আসছে। 

তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে অপটিকস বিদ্যাকে উন্নত করার কাজে। ১৬৮১ সাল হতে তিনি লম্বা দূরত্বের (যে দূরত্বে সবচেয়ে স্পষ্টত ছবি দেখা যায়) লম্বা লেন্স তৈরী করতে থাকেন। ছয় বছর গবেষণার পর তিনি প্রথম বিশাল দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এতে চোখ লাগাবার জায়গা রাখা হয়। এর ফোকাল দূরত্ব করা হয় ১৮০ ও ২০০ ফিট দূরত্বের। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন প্রথম আবিষ্কার করেন আলো আসলে কতকগুলি রঙয়ের সমষ্টি। আলোকে যদি পথ থেকে সরিয়ে বাঁকিয়ে দেয়া যায়, তবে রঙগুলোকে আলাদাভাবে দেখা সম্ভব। তিনি বিভিন্ন আলোর অবস্থানকে তরঙ্গ, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য, কম্পন নামে চিহ্নিত করলেন। আর তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্র রাতারাতি হাজারগুণ বেড়ে যায়।
আর্টিকেল টি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন
পরবর্তী প্রবন্ধ পূর্ববর্তী প্রবন্ধ
মন্তব্য নেই
মন্তব্য করুন
comment url