যেভাবে আবিষ্কার হলো আধুনিক টেলিফোন
টেলিফোন যন্ত্রের মাধ্যমে দূর-দূরান্তরের, দেশ-দেশান্তরের মানুষের সঙ্গে আমরা ঘরে বসেই আজকাল কথা বলতে পারি। হাজার হাজার মাইল দূর হতে প্রয়োজনীয় মানুষটির পরিষ্কার কণ্ঠস্বর শুনতে পারি। দূরকে কাছে টেনে এনেছে এই টেলিফোন যন্ত্র। যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় কে এই যন্ত্রটির আবিষ্কর্তা। অনায়াসে অনেকেই বলে ফেলবেন আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেলের নাম। গ্রাহাম বেল সত্যিই যন্ত্রটির স্বীকৃত আবিষ্কর্তা। কিন্তু অনেকেই জানেন না বেলেরও আগে অন্তত দশজন মানুষ টেলিফোন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নিরীক্ষা করেছেন। এদের মধ্যে দুজন আবার কার্যক্ষম টেলিফোন মডেলও তৈরী করেছিলেন। এদের একজনের নাম ফিলিপ রিস। জাতিতে জার্মান। বেলের আবিষ্কারের তের বছর আগেই তিনি অমার্জিত একধরনের টেলিফোন তৈরী করেছিলেন। তার টেলিফোনের মধ্য দিয়েও স্বর ট্রান্সমিট করা যেত। তার আবিষ্কৃত মডেলটি লণ্ডনের মিউজিয়াম অব সায়েন্সে রাখা আছে।
ফিলিপ রিস ১৮৬৩ সালে এটি আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রে বিদ্যুতের সাহায্যে সব ধরনের শব্দ পাঠানো বা গ্রহণ করা যেত, অর্থাৎ প্রথম টেলিফোন এটাই। কিন্তু এই আবিষ্কারকে পেটেন্ট (পেটেন্ট হলো আবিষ্কৃত কোন কিছু প্রস্তুত করার বা নকল করা থেকে রক্ষা করা সরকারি সনদ) করেননি ফিলিপ রিস। অথচ বেল তার উদ্ভাবিত টেলিফোন নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা গবেষণা করে নানা মডেলের টেলিফোন আবিষ্কার করলেন, এগুলো আলাদাভাবে পেটেন্টও করলেন। টেলিগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিসনের সাহায্যে শব্দ পাঠানোর যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য ১৮৭৫ সালের ২৭শে জুলাই শিকাগোর এলিজা গ্রে পেটেন্ট করার অধিকার পান। পরবর্তী বছরগুলোয় এলিজা বেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তার অভিযোগ বেল তার কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন, তথ্যাদি চুরি করছেন। কিন্তু গ্রের অভিযোগ আদালতে টেকেনি। কারণ হচ্ছে গ্রে শুধু স্বর প্রেরণের জন্য যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, আর বেল অনবরত পরিশ্রমের মাধ্যমে কার্যক্ষম টেলিফোনযন্ত্র তৈরী করে ফেলেছিলেন।
আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেলের অনেক আগে থেকেই ফেরার, বোউরসেল, ইয়েটেস, ভারলে, কুশম্যান, মিউন্সি, পেটরিনা, মানজেটি প্রভৃতি বিজ্ঞানীবর্গ টেলিফোন তৈরীর চিন্তা-ভাবনা করতেন। এদের মধ্যে গ্রাহাম বেলই সবচেয়ে পরিশ্রমী আবিষ্কর্তা ছিলেন, ফলে সাফল্যটা তারই এলো। ১৮৪৭ সালের ৩রা মার্চ আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল স্কটল্যাণ্ডের এডিনবরায় জন্ম গ্রহণ কনে। তার পিতা নাম আলেকজাণ্ডার মেলভিল। এই মেলভিল ছিলেন সে সময়ের একজন বিশ্ববিখ্যাত ধ্বনি-বিজ্ঞানী। মানুষের জিভ ঠোঁটের বিভিন্ন অবস্থানে কিভাবে বর্ণের উচ্চারণ হয় এ বিষয়ে তার প্রচুর গবেষণা ও বই লেখা ছিল। এ বিষয়ে তার গবেষণালব্ধ স্বরচর্চার যে কোড তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলো শুধুমাত্র স্কুল কলেজগুলোতে অভ্যাস করানো হতো তাই না, মুক ও বধিরদের ভাষা শেখানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। ১৮৬৬ সালে গ্রাহাম বেল তার বিখ্যাত পিতার স্বরবর্ণ দিয়ে কিভাবে গবেষণা করা যায়- বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করছিলেন, তখনই তার হাতে আশ্চর্যজনক একটি বই পড়ে। বইটির নাম, স্বরের অনুভূতি। লেখক বিখ্যাত পদার্থবিদ হারমেন ভন হেলমহোল্টস।
বইটি জার্মান ভাষায় লেখা, অনেক কষ্টে বেলকে পড়তে হয়। বইটি থেকে কিছু পরীক্ষা তিনি বেছে নেন। তখনকার দিনের বৈদ্যুতিক টিউনিং কর্ক (প্রায় Y আকারের ইস্পাতের যন্ত্র, এতে আঘাত করলে সুর তরঙ্গ ওঠে, বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যবহৃত হয়) দিয়ে স্বরবর্ণের কম্পন মাত্রা নিয়ে গবেষণা চালালেন। সৌভাগ্যবশত জার্মান ভালোভাবে পড়তে না পারায় গ্রাহাম বেল ভুলভাবে গবেষণা করেছিলেন। কারণ বইটিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল টিউনিং কর্কের কম্পনের উপর। এর বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশগুলোকে নয়। বেল ভুল করে গুরুত্ব দিলেন স্বরের বৈদ্যুতিক ট্র্যান্সমিসনের উপর। ফলে তার মাথায় চাপল টেলিগ্রাফের মতো কিছুর সাহায্যে স্বর প্রেরণ করার সম্ভাবনার বিষয়টি। ফলে তার মাথায় টেলিফোনের বীজ রোপিত হয়ে গেল। এর মধ্যেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন, বৈদ্যুতিক সার্কিটে 'লাগিয়ে ছেড়ে দিয়ে' শব্দাবলী দূরে টেলিগ্রাফ করা যায়। এই বিষয়টি উন্নতি ঘটিয়ে কাঁপানো কর্ক বা হালকা ধাতুর পাত কাঁপিয়ে যে শব্দ উৎপন্ন হয় সেটা তিনি প্রেরণ করতে পারবেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো বেলের মাথায় কখনোই দূরের মানুষের স্বর শোনার কোন চিন্তাভাবনা আগে থেকে ঢোকেনি। এই জাতীয় কাজের জন্য যে ধরনের ধ্যানধারণা প্রস্তুতি দরকার সেটাও বেলের ছিল না। এমনকি তা আগে যারা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন, সেই সব বিজ্ঞানীদের কার্যক্রমের কোন খোঁজ খবরও বেলের কাছে ছিল না, বা খবর রাখা প্রয়োজনও মনে করেননি।
প্রথম দিকে তিনি টেলিফোনের কথাই চিন্তায় আনেননি বরং প্রথমদিকে তার ইচ্ছা ছিল টেলিগ্রাফের মাধ্যমে স্বর পাঠানো। কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্রমপর্যায়ে তিনি টেলিফোন উদ্ভাবন করে বসলেন। ১৯২২ সালের ২রা আগস্ট তারিখে নোভাস্কটিয়া এলাকায় তার গ্রীষ্মকালীন বাড়ীতে বসে টেলিফোন আবিষ্কার করে ফেললেন। আগেভাগেই বেল একটি ধারণা পেয়ে গিয়েছিলেন যে, বৈদ্যুতিক সার্কিটে লাগিয়ে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি চুম্বকের সাহায্যে দ্রুত ঘটাতে পারলে ধাতব পাত দ্রুত সংযোজিত বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্রুত ওঠানামা করবে, ফলে এরা সঙ্গীতের সরগম প্রেরণ করতে পারবে যেমনটি করে টেলিগ্রাফের টরে-টক্কা। বেল একের পর এক পরীক্ষা চালালেন। কিন্তু দ্রুত ছাড়া ধরার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তিনি আবিষ্কারে ব্যর্থ হলেন। মানুষের কণ্ঠস্বর, গলার গঠনের উপর বেলের পৈত্রিকসূত্রে অসাধারণ দখল ছিল। এবার তিনি ধাতব পাতের বদলে লম্বা পাতলা আবরণ বসিয়ে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর ধরা ছাড়ার জন্য একটি লিকুইড ট্রান্সমিটার ব্যবহারের কথা চিন্তা করলেন।
এই পরীক্ষার বিষয়টি পেটেন্ট করা হয় ১০ই মার্চ ১৮৭৬ সালে। এই ঘটনার তিন দিন পর অনেকদিনের বিশ্বস্ত সহগবেষক ভান বোস্টনের ৫৯৩ এক্সেটর প্লেসে বাড়ী ভাড়া করে গবেষণাগার স্থাপনা করলেন। এ বাড়ীটি অনেকটা মিলনায়তনের মতন, একপাশে একটুখানি গ্যালারী আছে। মিলনায়তনটির একটি পাশে একটি ঘরে বেল ঘুমাতেন, অন্যপ্রান্তে ছিল গবেষণাগার। দুটো ঘরের মধ্যে একটি তার দিয়ে সংযোগ করা ছিল। একদিন বেল তার ঘরে ঘুমানোর আয়োজন করছেন, অন্যদিকে ওয়াটসন গবেষণাগারে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ঘর দুটো এতো দূরে যে সাধারণ গলার স্বর স্বাভাবিক কথোপকথনে একঘর থেকে অন্য ঘরে পৌঁছায় না। সেদিনটায় সারা দিনে কোন কাজ হয়নি। সব পরীক্ষাই ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে সারাদিনের পরিশ্রমের ব্যর্থতায় বেল অস্থির হয়ে উঠেছিলেন, ঘুম আসছিল না। অগত্যা ঘরের ভিতরই গবেষণার জিনিসপত্র এনে পরীক্ষা শুরু করলেন। বাইরের কোন কিছুই তার খেয়াল নেই, কোন ঘরে আছেন সে খেয়ালও নেই।
অসাবধানে হঠাৎ তিনি একটা কাজ করে বসলেন। তিনি তখন নড়াচড়া করছিলেন লিকুইড ট্র্যান্সমিটার, হাত লেগে পাশে রাখা পাতলা এসিডের পাত্রটি উল্টে দেন। এসিড ছড়িয়ে পড়ে টেবিলে, তার শরীরে। বেলের খেয়াল নেই যে, ওয়াটসন গবেষণাগারে তার থেকে অনেকটা দূরে বসে কাজ করছেন। ঘরে বসেই হতচকিত হয়ে। তিনি হঠাৎ ওয়াটসনকে এ ঘরে আছে মনে করে ডেকে বসলেন, 'মিঃ ওয়াটসন এখানে আসুন, আপনাকে আমার দরকার।' প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেলের ঘরের দরজা খুলে ওয়াটসন পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলেন মিঃ বেল আপনার বলা প্রতিটি শব্দ আমি শুনতে পেয়েছি। একেবারে পরিষ্কারভাবে। বেল এবং ওয়াটসনের মধ্যেকার সংলাপগুলি আজ বিশ্ববিখ্যাত। বেলের ওয়াটসনকে ডেকে আনাটাই পৃথিবীর ইতিহাসে টেলিফোনে প্রেরিত প্রথম সংলাপ। ১৯১৬ সালের ১৭ অক্টোবর তারিখে শিকাগোতে টেলিফোন অগ্রদূতদে বসে তাতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওয়াটসন বলেছিলেন, আমি আজ বিশ্বাসই করতে পারছি না কেন পরিষ্কার অর্থবহ স্বর শুনতে আমাদের সে-বছর (১৮৭৬) সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সময় লেগেছিল।
ঘটনাটি আমাকে এমন অভিভূত করে ফেলেছিল যে সে দিনের প্রতিটি কথা আমি আমার ডাইরীতে লিখে রেখেছি। আজও তা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। সেদিনকার কোন ঘটনাই সাজানো বা মহড়া দেয়া ছিল না, যেমনটি মোর্সরা তাদের টেলিগ্রাফ নিয়ে বছরের পর বছর করেছিলেন। যদি সেদিন মিঃ বেল বুঝতে পারতেন তিনি ঐতিহাসিক কিছু করতে যাচ্ছেন, তা হলে তিনি অনেক প্রস্তুতি নিয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ আকর্ষণীয় শব্দাবলী প্রথম টেলিফোন ম্যাসেজ হিসাবে বলতেন। ঐ কনভেনসনের ২ বছর পর ১৯১৪ সালে আন্তমহাদেশীয় টেলিফোন লাইন বসানো হয়। ডঃ বেল থাকলেন নিউইয়র্কে, মিঃ ওয়াটসন গেলেন সানফ্রান্সসিসকোতে। ডঃ বেলের সামনে বিশাল জনতা অপেক্ষা করছিল। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এসিড ফেলে দিয়ে যে সংলাপটি বেল বলেছিলেন সেই সংলাপই এত বছর পর ওয়ার্টসনকে আবার বললেন, মিঃ ওয়াটসন এখানে আসুন, আপনাকে আমার দরকার।
আশেপাশের লোকজন দরুণ মজা পেল যখন তারা ওয়াটসনের উত্তর শুনল, বললেন, আসতে পারলে খুশী হতাম, কিন্তু আপনার কাছে আসতে আমার অন্তত সপ্তাহ খানেক লাগবে। গ্রাহাম বেলের সেই প্রাথমিক নড়বড়ে কাঠের টেলিফোন থেকে আজকের ডায়েল টেলিফোনে পৌছুতে অনেক দিন লেগেছে। এই সময়ে থমাস আলতা এডিসন ও অন্যান্য আবিষ্কারকদের পরবর্তীতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে টেলিফোনই হচ্ছে ব্যবসার সবচেয়ে জরুরী উপকরণ। কোটি কোটি মানুষ সারা পৃথিবীব্যাপী পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে, আলোচনা করছে, সবই টেলিফোনের মাধ্যমে। বেল যে পেটেন্ট তৈরী করেছিলেন তার উপরই নির্ভর করে আজকের রেডিওর মাইক্রোফোন, লাউড-স্পিকার তৈরী হয়েছে।