বিদ্যুৎ আবিষ্কারের দীর্ঘ ইতিহাস ও খুঁটিনাটি
আজকাল শহরগুলো ছাড়াও দূরের গ্রামগুলোতেও বিদ্যুৎ চলে গেছে। শহরের অধিকাংশ বাড়ীতে টেলিভিশন, কম্পিউটার ছাড়াও আলো হাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাটিয়ে। কলকারখানা চলছে, অফিস-আদালত চলছে, ক্ষেতে জলসেচ হচ্ছে, সিনেমা এমনকি রাতে ফুটবল খেলা পর্যন্ত চলছে বিদ্যুতের সাহায্য নিয়ে। বিদ্যুতের ব্যবহারে আমরা এতই অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি যে বাতি জ্বালাতে, পাখা ঘোরাতে অথবা হীটার দিয়ে চায়ের পানি গরম করতে, বা ইস্ত্রি দিয়ে জামাকাপড় ডলে নেবার সময় আমরা আমাদের মাথাতেই রাখি না যে, সুইচ টিপলে আলো হয় বা পাখা ঘোরে যার সাহায্যে সেই বিদ্যুৎকে মানুষের আবিষ্কার করতে হয়েছে, তাকে বাঁধতে হয়েছে, নিজের কাজের উপযোগী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। সেই আদিকালে কে কবে আকাশে বিদ্যুৎ চমক দেখে, একে বশ করার কথা চিন্তা করেছিল তা আজ আর জানা যায় না। তবে সেদিন সে-সময়ের লোকজন বিদ্যুৎ বজ্রপাতকে ভয়ই পেত, একে কাজে লাগানোর কথা কেউ চিন্তাও করেছে বলে মনে হয় না। আকাশে বিদ্যুৎ চমক দেখে মানুষ হয়তো এর বিপুল ক্ষমতা সম্বন্ধে ভাবতে পেরেছিল, তবে আকাশের মেঘের ঠোকাঠুকির বিদ্যুৎ দেখে মানুষ বিদ্যুৎ আবিষ্কারের চেষ্টা করেনি। মানুষ আকাশের বজ্রপাতের বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছে, নিজহাতে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের অনেক পরে।
তাহলে কিভাবে বিদ্যুৎ আমাদের হাতে এলো? অনেক দিন আগের কথা। ইংল্যাণ্ডের রাণী তখন প্রথম এলিজাবেথ। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের নাম ছিল উইলিয়াম গিলবার্ট। তার ছিল বিজ্ঞানে দারুণ আগ্রহ। প্রায়ই তিনি চুম্বক আর এ্যাম্বার নামে এক ধরনের পাথর নিয়ে নানারকম পরীক্ষা চালাতেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন চুম্বক লোহাকে টেনে নেয়; এ্যাম্বার পাথরকে টানে না। কিন্তু এ্যাম্বার পাথরকে ঘষে নিলে চুম্বক তাকে টেনে নেয়; শুধু তাই নয় অন্যান্য হাল্কা কিছু ধাতুও ঘষা এ্যাম্বার পাথর টেনে নেয়। ১৬০০ সালে তিনি তার এই আবিষ্কারটির কথা প্রকাশ করলেন। আসলে মানুষের কোন আবিষ্কারই এক ধাপে হয়নি। পরবর্তী বিজ্ঞানীরা গিলবার্টের ঐ সামান্য আবিষ্কারকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। চুম্বক আর এ্যাম্বার দুটো সামান্য বস্তুর আকর্ষণ করার ক্ষমতা দেখে তিনি যেমন অবাক হয়েছিলেন, তেমনি কেন হচ্ছে সেটা ভেবে পাননি। তার ধারণা ছিল চুম্বক শুধু লোহাকেই টানে। অথচ এ্যাম্বার তো চুম্বক নয়, তাহলে একে ঘষলে হালকা ওজনের প্রায় সবকিছুই টেনে নেয়। এ রকম কেন হবে? এরপর বহুবছর পরীক্ষা গবেষণার পর গিলবার্ট তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন গবেষণার ফলে মানুষ একদিন কাঁচ, শক্ত রাবার, গালা, এমনকি তেলকে পর্যন্ত চুম্বকের গুণ দেয়া সম্ভব, আর এগুলোর মাধ্যমেই এক নতুন বিজ্ঞান আবিষ্কার হবে। এই বিজ্ঞানের নাম বিদ্যুৎ, তিনিই দিয়েছিলেন। এ্যাম্বার ধাতুকেই সামনে রেখে নতুন বিদ্যাটির নাম হয় ইলেকট্রিসিটি। গ্রীক ভাষায় এ্যাম্বার ধাতুর নাম ইলেকট্রন। ডঃ গিলবার্টের গবেষণা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন অঞ্চলের পণ্ডিতেরা এই নতুন শক্তির গুপ্ত রহস্য খুঁজে বের করতে খাটতে লাগলেন। এর মধ্যে ১৭২৯ সালে আর একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী স্টিফেন গ্রে আশ্চর্য একটা বিষয় আবিষ্কার করে ফেললেন। তিনি দেখতে পেলেন, বিদ্যুৎ একটি ধাতুর এক অংশ থেকে অন্য অংশে পাঠানো যায়।
বিদ্যুৎ লাগানো কোন বস্তুকে তিনি সুতোর সাহায্যে অন্য মাথায় ৭০০ ফুট দূরের সর্ষের বীজ আকর্ষণ করাতে সক্ষম হলেন। যে বস্তুটির মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাঠানো হয়, তিনি তার নাম দিলেন কনডাকটর বা বিদ্যুৎ পরিবাহী। আর যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাঠানো যায় না তার নাম দিলেন ইনসুলেটর বা অন্তরক। বছর কয়েক পরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দুই ধরনের বিদ্যুতের বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; এদের নাম রাখা হয় পজিটিভ বা ধনাত্মক, নিগেটিভ বা ঋণাত্বক। যে বস্তুতে এই দুই ধরনের বিদ্যুৎ থাকবে, সে বস্তুটিকে বলা হবে চার্জড বা বিদ্যুৎসম্পন্ন। একই ধরনের চার্জ একে অপরকে সরিয়ে দেয়, আবার বিপরীত ধরনের চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
এর মাধ্যমেই বিদ্যুতের প্রথম সূত্রটি আবিষ্কৃত হয়। আজ থেকে তিনশো বছর আগেই মানুষ জেনে যায় যে, বিদ্যুৎ অপরিবাহী বস্তু, যেমন- কাঁচ, শক্ত রাবার, এ্যাম্বার ইত্যাদির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চালাতে হলে বস্তুগুলিকে আগে ঘষে নিতে হবে। বস্তুগুলিকে যত জোরে, যত তাড়াতাড়ি ঘষা হবে, এগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক চার্জও তত জোরালো হবে। এই চার্জ উৎপাদনের জন্য প্রথম দিকে অপরিবাহী বস্তুগুলিকে খালি হাতে ঘষা হতো। পরে ঘষার জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র তৈরী করা হয়। এই যন্ত্রে একটি চাকা ঘুরত; চাকার মাধ্যমে অপরিবাহী বস্তুটিকে ঘষে নেয়া হতো। এই যন্ত্র ব্যবহারে শুধুমাত্র জোরালো চার্জই উৎপন্ন করা গেল না, উৎপাদিত চার্জকে বিশেষভাবে তৈরী করা কাঁচের পাত্রে ধরে রাখার ব্যবস্থাও করা হলো। এই ধরনের কাঁচ পাত্রের নাম দেয়া হলো লেডেন জার, কারণ পাত্রগুলো হল্যান্ডের লেডেন শহরে থেকে আসত।
এই লেডেন কাঁচ পাত্রগুলো অনেকটা বয়ামের মতো। এগুলোর ভিতরের পিঠ ও বাইরের পিঠ টিনের পাতলা আবরণ দিয়ে মোড়া থাকত। পাত্রটির মুখে অপরিবাহী ছিপি থাকত, আর ছিপিটি ছিদ্র করে ধাতুর তৈরী একটি কাঠি ঢুকিয়ে দেয়া হতো। কাঠির উপরের অংশে গোল একটা বল থাকত আর নীচের অংশে পাত্রটির তলা ছোঁয়া একটি শিকল থাকত। পাত্রটির বলের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে বাইরে থেকে মেশিনের সাহায্যে বিদ্যুৎ পাঠানো হতো, আর পাত্রটির তলা মাটির উপর রাখা হতো। পাত্রের মধ্যে ঢুকে পরা বিদ্যুতের চার্জ, ধাতুর কাঠি, তারপর শিকল বেয়ে পাত্রটির তলায় নেমে আসত। পাত্রের ভেতরটা নিগেটিভ চার্জে ভরে যেত। সেই সঙ্গে পাত্রের বাইরের অংশের সমস্ত নিগেটিভ চার্জকে মাটিতে তাড়িয়ে দিত। ফলে পাত্রের বাইরের অংশে পজেটিভ চার্জে ভরে যেত। যত বেশী চার্জ পাত্রটির মধ্যে ঢোকানো হতো, পাত্রটিতে ততটা চার্জই সংরক্ষিত হয়ে যেত। অনেকটা পুকুরে পানি রাখার মতো। এই পাত্রগুলোয় চার্জ ধারণ ক্ষমতা নির্ভর করত মুড়িয়ে থাকা টিনের আবরণ, আর কাঁচ কতটা পুরু তার উপর। তবে বেশী চার্জ জমে গেলে পাত্রটির বলে হাত রাখা বিপদজনক, কারণ এতে ভয়ানকভাবে বিদ্যুতের ধাক্কা খাবার সম্ভাবনা থাকে। বিদ্যুৎ ধরে রাখবার জন্য লেডেনের পাত্র আবিষ্কার বিদ্যুৎবিদ্যার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই আবিষ্কার বিদ্যুৎবিদ্যাকে হঠাৎ করেই কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। তখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতেন না এই পাত্র দিয়ে কি হবে? একে কিভাবে কাজে লাগানো যাবে? অনেক পরে আজকাল রেডিও টেলিভিশনে যে ধারকযন্ত্র কনডেনসার আছে তা এই লেডেনের পাত্র ছাড়া আর কিছুই না। হতে পারে এই কনডেনসার যাকে এখন ক্যাপাসিটার বলা হয়ে থাকে- এটি সেকালে আবিষ্কৃত হয়ে থাকলেও, বেনজামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের বিখ্যাত পরীক্ষার আগে পর্যন্ত এর গুরুত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে, তেমন একটা ছিল না। ফ্র্যাঙ্কলিন আমেরিকার মানুষ। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে তাঁর জন্ম। তিনিই প্রথম বললেন যে, বিদ্যুৎ অনেকটা তরল পদার্থের মতো। তিনি বললেন সব বস্তুতেই এই পদার্থ, অর্থাৎ বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু চার্জ দেবার আগে কোন বস্তুতেই বিদ্যুতের অস্তিত্ব বোঝাই যায় না। তিনি আরও জানালেন ধনাত্মক চার্জ দেয়া কোন বস্তুতে সাধারণ পরিমাণের চেয়ে বেশী পরিমাণ এই তরল পদার্থ থাকে, আর ঋণাত্মক চার্জ দেয়া বস্তুতে সাধারণ বিদ্যুৎ পরিমাণের চেয়ে কম তরল থাকে। বেনজামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের এই কথার উপর নির্ভর করে আমাদের আজকের দিনের বস্তুর মধ্যের ইলেকট্রন প্রোটনের জ্ঞানের জন্ম নেয়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় ফ্র্যাঙ্কলিনের সময় পরমাণুর ভেতরের গঠন সম্বন্ধে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না। ফ্র্যাঙ্কলিন আরও দাবী করলেন যে আমাদের আবহ-মণ্ডলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ রয়েছে।
এই বিদ্যুৎ ইলেকট্র-স্ট্যাটিক মেশিনে তৈরী করা লেডেন পাত্রে রাখা বিদ্যুতেরই মতো। এটা প্রমাণ করার জন্য ১৭৫২ সালে তিনি আকাশে একটা ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। তার সেই ঘুড়ি ওড়ানোর মাধ্যমে আবহ-মণ্ডলের বিদ্যুৎ আবিষ্কার বিজ্ঞানকে নতুন খোঁজ দিয়ে দারুণ সহায়তা করে। একদিন আকাশে মেঘেদের ঠোকাঠুকিতে তুমুল বাজ-বিদ্যুৎ পড়ছিল। সিল্কের দুই সুতোয় পাকানো ঘুড়ি ওড়ানোর দড়িটি তিনি ইনসুলেটর দিয়ে মুড়িয়ে নিয়েছিলেন যাতে দড়ি দিয়ে বাহিত বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ না হয়ে যায়, এই দড়িটির শেষ মাথায় তিনি একটি চাবি বেঁধে দিয়েছিলেন। দেখা গেল ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ঘুড়ির উপর দিয়ে অথবা কাছ দিয়ে মেঘ সরে গেলেও চাবিটি বিদ্যুৎচমকে ঠিকরে ওঠে। এরপর সেখানে লেডেনের পাত্র এনে দড়ির সঙ্গে তিনি জুড়ে দেন। দেখা গেল বজ্রপাতে লেডেনের পাত্র চার্জ হচ্ছে, আর এই চার্জের গুণাগুণ ইলেকট্র-স্ট্যাটিক মেশিনে তৈরী বিদ্যুতের সমান। ফলে সবাই তখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন যে, আমাদের আবহ-মণ্ডল বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ধারণ করে আছে। ১৭৬০ সাল পর্যন্ত সবাই এক ধরনের বিদ্যুতের কথাই শুধু জানত, আর এই জানাও তেমন গভীর ছিল না। তখন বিদ্যুৎকে বলা হতো স্থির বিদ্যুৎ। সেকালের মানুষজনের ধারণা ছিল, এই স্থির বিদ্যুৎ এক ধরনের জিনিস যা পাত্রে আটকে রাখা যায়। অনেকটা, গৃহিনীরা যেমন বয়ামে আচার রেখে দেয়। লেডেন পাত্রের বিশাল গুরুত্ব সম্পর্কে সেকালের মানুষজনের কোন ধারণাই ছিল না; তারা বিভিন্ন আকারের লেডেন পাত্র তৈরী করে বিভিন্ন আকারের বিদ্যুৎচমক সৃষ্টি করে আনন্দ পেত।
আমাদের সভ্যতার সৌভাগ্য, বৈদ্যুতিক পরীক্ষা সেখানেই থেমে থাকেনি। ফ্র্যাঙ্কলিনের ঘুড়ি ওড়ানোর আটাশ বছর পর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সম্পর্কে মানুষের ধারণার তেমন কোন হেরফের হয়নি। কিন্তু মানুষের আবিষ্কারের নেশা তো থেমে থাকে না। এবার এলেন ইতালীর বোলোগনা এলাকার মানুষ লুইগী গ্যালভানী। তাঁর পরীক্ষার বিষয় ছিল ব্যাঙের পায়ে বিদ্যুতের প্রতিক্রিয়ায় কিভাবে সংকোচন হয়, সেটা তিনি পরীক্ষা করছিলেন। আর সেটা করতে গিয়েই তিনি বিদ্যুৎ প্রবাহের সূত্র আবিষ্কার করে ফেললেন। যখনই ইলেকট্র-স্ট্যাটিক মেশিনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক স্পার্ক ব্যাঙের পায়ে লাগানো হয়, তখন তা দারুণভাবে নড়ে ওঠে। তিনি ভাবতে লাগলেন, ব্যাপারটি তবে কি দাঁড়াল? অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌছুলেন ব্যাঙের নড়ে ওঠা দ্বারা বোঝা যায়, ব্যাঙের পায়েও বিদ্যুতের অবস্থান আছে, নতুন ধরনের বিদ্যুতের সঞ্চার হয়। এর নাম দেয়া হলো- বৈদ্যুতিক প্রবাহ। ব্যাঙের পা যদিও সামগ্রিক অর্থে বিদ্যুৎ পরিমাপক, তবুও আবিষ্কারের সময় গ্যালভানী এর প্রয়োজনীয়তাটি ততটা বুঝতে পারেননি। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তিনি বুঝতে পারলেন বিদ্যুৎবিদ্যার অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয় তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
এই আবিষ্কার নিয়েই তিনি ছ'বছর কাটালেন। শেষের দিকে তিনি তার ল্যাবরেটরীর ছাদে বিদ্যুৎওয়ালা একটি লোহার পাত খাড়া করে রাখলেন। তারপর লোহার পাতটির সঙ্গে একটি তামার কাঠি সংযোগ করে অন্যমাথা একটি ব্যাঙের স্নায়ুকেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিলেন। ব্যাঙটির পায়ের দিকটা মাটির সঙ্গে লাগিয়ে রাখলেন যাতে বিদ্যুৎ ঝলক ব্যাঙের শরীর দিয়ে মাটিতে চলে যেতে পারে। এবার দেখা গেল আকাশে বজ্রপাত হলেই মরা ব্যাঙটির শরীর ঝাঁকি খেয়ে ওঠে। এর ফলে গ্যালভানী সিদ্ধান্তে এলেন ব্যাঙের পায়ের ঝাঁকুনী খাবার কারণ হলো, ব্যাঙের স্নায়ুকেন্দ্রের ধনাত্মক চার্জ ব্যাঙের পায়ের ঋণাত্মক চার্জের সঙ্গে মিলে যাওয়া। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন উভয় চার্জই তৈরী হচ্ছে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে উপস্থিত বিদ্যুতের প্রাকৃতিক মিলনের ফলে। তাঁর কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। গ্যালভানীর সিদ্ধান্ত ভুল হলেও তার গবেষণা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে আলেসান্দ্রো ভোল্টা নামে একজন বিজ্ঞানী অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে গ্যালভানীর পরীক্ষা লক্ষ্য করছিলেন। তিনিও ইতালী দেশীয় বিজ্ঞানী।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিনিই বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরী করতে সক্ষম হন। ভোল্টা কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে পৌঁছেন গ্যালভানীর পরীক্ষার সূত্র ধরেই। তিনি দেখতে পেলেন অন্য জিনিস। দেখলেন গ্যালভানীর পরীক্ষায় দুটো পৃথক ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, লোহা ও তামা। তাঁর মনে হলো বিদ্যুৎ প্রবাহ একধাতু থেকে অন্য ধাতুতে প্রবাহিত হচ্ছে, আর মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে ব্যাঙের পায়ের মধ্যকার জৈবিক জলীয় কণা। বিষয়টি লক্ষ্য করে তিনি একটি ধারণায় আসতে চাইলেন। সেই অনুযায়ী তিনি অনেকগুলো একই মাপের তামা, দস্তা ও ভেজা কাগজের কতকগুলি চাকতি কাটলেন। এই চাকতিগুলোকে এবার তিনি একটি বিন্যাসে সাজিয়ে নিলেন। সাজানোটা এই রকমের ছিল, তামা, দস্তা, ভেজা কাগজ, আবার তামা, দস্তা, ভেজা কাগজ। যখন তিনি প্রথম তামার চাকতির সঙ্গে শেষের দস্তার চাকতির সংযোগ দিলেন, তখন হঠাৎ তিনি হাতে বিদ্যুতের শক্ খেলেন, অনেকটা লেডেনের পাত্র থেকে বের হওয়া চার্জের শকের মতো। নিঃসন্দেহে দারুণ আবিষ্কার। বিদ্যুৎ তৈরী করা গেল। এর জন্য কোন ধাতুকে ইনসুলেটর বা আন্তরক দিয়ে ঘষবার প্রয়োজন হয়নি, কোন বিদ্যুৎ উৎপাদক ইলেকট্র-স্ট্যাটিক মেশিন ঘোরাতে হয়নি, আগেকার দিনে এ্যাম্বার ধাতু, কাঁচ অথবা চুম্বকের প্রয়োজন পড়েনি।
এখানে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরী হলো, দুটো ভিন্নধাতু। আর ভেজা কাগজের কেরামতীতে। ভোল্টার এই আবিষ্কার সবাই গ্রহণ করলেন, তবে বিদ্যুতবিদ্যার মূল কোথায় এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। এবার এগিয়ে এলেন সেকালের কেমিস্ট অর্থাৎ রসায়নবিদেরা। তাঁরা ভেজা কাগজের বদলে পানি মেশানো পাতলা সালফিউরিক এসিড ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। তৈরী হলো প্রথমবারের মতো ভোল্টার সেল; প্রথম বৈদ্যুতিক ব্যাটারী। একটি কাঁচের পাত্রে পাতলা সালফিউরিক এসিড রাখা হয়, আর তামা ও দস্তার দুটো পাত বসিয়ে দেয়া হয়, তারপর একটি ধাতুর তৈরী পরিবাহী তার দিয়ে তামা, দস্তার পাত দুটোয় সংযোগ দেয়া হয়। ব্যাস, এভাবেই তৈরী করা হলো ভোল্টার সেল। দিনে দিনে এই ব্যাটারীর ব্যবহার বাড়তে লাগল। অনেক উন্নয়ন সাধন করাও হলো। বাণিজ্যিকভাবেও ভোল্টার ব্যাটারী আরও শক্তিশালী কার্যক্ষম করে ব্যবহার হতে লাগল। ভোল্টার এই আবিষ্কার সেকালে দারুণ সারা জাগিয়েছিল। ভোল্টা আজকের পৃথিবীর একজন অমর বিজ্ঞানী হিসাবে ইতিহাসে বেঁচে রইলেন। ভোল্টার সেল আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই বিদ্যুৎ গবেষণার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হলো। এবার বিজ্ঞানীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়াল বৈদ্যুতিক প্রবাহ।
বিদ্যুৎকে কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারী তৈরী করা হলো। স্কুল কলেজে নানা রকমের পরীক্ষা চালানো হলো। ভাবতে অবাক লাগে যে সেই ১৮০০ সাল থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা করার একশো বছর পরেও মানুষ বৈদ্যুতিক শক্তির বিশাল সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেনি বা সম্ভাবনার দরোজা খোলার চাবিকাঠিও পায়নি। ব্যাটারী দিয়ে মোটর চালানোর বিষয়টি তখনো মাথায় আসেনি, কারণ তখন মোটরই তৈরী হয়নি। এই ব্যাটারীকে অনেক কাল অপেক্ষা করতে হয়েছে, আধুনিক পৃথিবীর মহান সব আবিষ্কার টেলিফোন, টেলিগ্রাম, রেডিওর জন্য। ভোল্টার সেল আবিষ্কারের ২০ বছর পর, ডেনমার্ক দেশের হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েস্টেড নামের একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান অধ্যাপক বিদ্যুৎ বিদ্যার নতুন পথ খুলে দিলেন। তিনি বিদ্যুতের সঙ্গে চুম্বক জুড়ে দিলেন। ফলে সৃষ্টি হলো নতুন পৃথিবীর নতুন বিজ্ঞান ইলেকট্র ম্যাগনেটিজম।
ওয়েস্টেডের গবেষণার, সঠিক সময়টি জানা যায়নি; সম্ভবত ১৮২০ সালেই হবে। ওয়েস্টেড অনেকদিন ধরেই বিদ্যুৎ রসায়নের বিষয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। এই পরীক্ষা চালানোর সময় তাঁর মনে হলো, বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালিয়েই তাপ তৈরী করা যাস এর দ্বারা তবে চৌম্বক ক্ষেত্রও তৈরী করা যায় এবং এর ফলে এর সাহায্যে কম্পাসের চুম্বক কাঁটাকেও প্রভাবিত করা যাবে। বিষয়টি তাঁকে পেয়ে বসল। একদিন তিনি তাঁর ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে তাদের নিয়ে এলেন তাঁর বাড়ীর গবেষণা কামরায়; তারপর তাদেরকে ইলেকট্র ম্যাগনেটিজম সম্পর্কে বোঝালেন। অবশ্য সেদিনের ছাত্ররা বুঝতেই পারেনি যে তারা সেদিন থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রথম পা রাখলেন। ওয়েস্টেড ভাবলেন, এবার তাঁর আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের ডেকে দেখানো যাক। ভাবনা অনুযায়ী ব্যবস্থাও করলেন। কিন্তু প্রথম দিনেই দারুন লজ্জা পেলেন। একটি ব্যাটারীর সঙ্গে তারের সংযোগ দিয়ে কম্পাসের কাছাকাছি আনা হলো; সামান্য একটু কেঁপে ওঠা ছাড়া কম্পাসের কাঁটা আর কিছুই করল না।
দর্শকরা মোটেই খুশী হলেন না। ওয়েস্টেডও হতভম্ব হয়ে পড়লেন, তবে মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন শক্ত ধাতুর। ভেঙ্গে পড়লেন না, উদ্যমও হারালেন না। নিজের প্রতিভা সম্পর্কে তার যথেষ্ট সচেতনতা ছিল, ছিল আত্মবিশ্বাস; অবিরাম পরীক্ষা চালানোর ধৈর্য্য তাঁর ছিল। দিন কয়েক পরের ঘটনা। এবার তিনি বেশ শক্তিশালী একটা ব্যাটারী বানালেন, আর সেটায় তার সংযোগ দিয়ে কম্পাসের কাছে আনতেই তিনি দেখতে পেলেন, কম্পাসের কাঁটাটি সরে গিয়ে বৈদ্যুতিক আবেশে স্থির হয়ে আছে। কাঁটাটির এই ধরনের ব্যবহার ওয়েস্টেড চাননি। ব্যাটারী সংযুক্ত তার যখন; কাঁটার সমকোণে আনা হয়, তখন কোন নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু তারটি কাঁটার সমান্তরালে যখন আনা হয় তখন কাঁটাটি প্রায় ৯০ ডিগ্রীতে সরে আসে। কাঁটার এই ধরনের ব্যবহারের কারণ কি? আরো মজার ব্যাপার তারটি কম্পাসের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিলে কাঁটাটি কেন পশ্চিম দিকে ঘুরে আসে? আর পূর্ব দিকে ঘুরে যায় যখন কম্পাসের নীচ দিয়ে তারটি আনা হয়? এই প্রশ্নগুলো ওয়েস্টেডের মাথায় উত্তরের অপেক্ষায় দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াতে লাগল। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অসীম ধৈর্য নিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা চালালেন ওয়েস্টেড।
ওয়েস্টেড প্রশ্নগুলোর শুধু সমাধানই করলেন না, অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরলেন বৈদ্যুতিক চৌম্বক বিদ্যার মৌলিক সূত্রগুলো। তিনি প্রমাণ করে দেখালেন তারের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালালে তারের আশেপাশে চুম্বক ক্ষেত্র তৈরী হয়। বিদ্যুৎ আর চুম্বকের মধ্যে যে সম্পর্কের বিষয়টি ওয়েস্টেড আবিষ্কার করেছিলেন, তার গুরুত্ব সম্পর্কে সেকালের বিজ্ঞানীরা ঠিক ধারণা করতে পারেননি। তাঁরা বুঝতেই পারেননি এই আবিষ্কার তাঁরা কি কাজে লাগাবেন। কিন্তু অল্পদিনেই প্রমাণ হলো ওয়েস্টেডের আবিষ্কার পৃথিবীর মহৎ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাঁর আবিষ্কারের মূল বিষয় হলো, যদি কোন তারের মধ্যে বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালিয়ে দেয়া যায়, তবে সেই তারটির খুব কাছাকাছি চৌম্বক আবেশের সৃষ্টি হবে, যেদিক থেকে বিদ্যুৎ চালানো হবে কম্পাসের কাঁটা তার উল্টোদিকে চলবে, তা সে বিদ্যুৎ প্রবাহ ঋণাত্মক বা ধনাত্মক যাই হোক না কেন। এই আবিষ্কারের সূত্র ধরে শুধু মাত্র ইলেকট্র ম্যাগনেটিক বিদ্যার সূচনাই হয়নি, পরবর্তী কালে 'মোটর রুল' পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এই মোটর রুল থেকেই বৈদ্যুতিক মোটরের আবিষ্কার হয়েছে। এই আবিষ্কারের পথ ধরে মাইকেল ক্যারাডে এসেছেন, প্রথম বৈদ্যুতিক জেনারেটর তৈরী হয়েছে, অজস্র বৈদ্যুতিক যন্ত্র, এবং আবিষ্কার হয়েছে বৈদ্যুতিক শব্দ প্রেরক যন্ত্র। আজকের দিনের রেডিও, টেলিভিশনের মতো যন্ত্রপাতিও ওয়েস্টেডের আবিষ্কারকে ভর করে তৈরী হয়েছে।