বাষ্পীয় ইঞ্জিন যেভাবে অবিষ্কার করা হয়েছিল
বাষ্প চালিত রেলগাড়ী বা স্টীমার এখনও একেবারে উঠে যায়নি। মানুষ কিভাবে বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে এত বড় বড় যানকে গতি দিয়েছিলেন। এটা আজ আর ততটা বিস্ময়কর নয়। কারণ বাষ্পীয় যানের অনেক কারিগরীই এখন সাধারণ মানুষের সাধারণ জানাশোনার মধ্যে। অথচ দু'শো বছর আগে পর্যন্ত এই ধরনের যানবাহনের বাস্তব কোন ধারণা পর্যন্ত ছিল না। মানুষ অবশ্য ভেবেছে অনেক আগে থেকে। আজকের দিনে সবাই নিশ্চয়ই চমকে উঠব, যে বাষ্পীয় ইঞ্জিন প্রথম তৈরী হয়েছিল দু'হাজার বছরেরও আগে। আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রীক বিজ্ঞানী হেরো প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরী করেছিলেন। কার্যকারীতার দিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্য যন্ত্রটি ছিল মূল্যহীন। শুধু মাত্র নতুনত্বের মোহে আলেকজান্দ্রিয়ার বড়লোকদের মেলায় যন্ত্রটি দেখানো হয়েছিল।
সেখানে কেউই অদ্ভুত যন্ত্রটির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। এমনকি হেরো নিজেও বোঝেননি। এ বিষয়কে গুরুত্ব দিতে, এর সম্ভাবনার দিকটি খুঁজে নিতে মানুষকে আঠারো শতাব্দীরও বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। সপ্তদশ শতকের দুজন মানুষ। তাদের মাথায় চাপল বাষ্প থেকে শক্তি উৎপাদন করা যায়। লোক দুজনের নাম থমাস সাভেরী ও থমাস নিউকোমেন। এরা বাষ্প নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেন। এদের মধ্যে থমাস সাভেরীকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা হিসেবে মেনে নেয়া চল যন্ত্রটিকে মোটেই ইঞ্জিন বলা যায় না। সাভেরী পেশায় ছিলেন নাবিক। একদিন তিনি ইংল্যাণ্ডের সমুদ্র উপকূলের একটি সরাইখানায় খাবার খাচ্ছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলেন একব্যক্তি তার সামনে কিছুটা গরম জল ভরা বোতল আনলেন। বোতলটি বাইরে থেকে তখনই ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করা হলো। সাভেরী দেখলেন ভেতরের পানি ঠাণ্ডা হবার সঙ্গে সঙ্গে বোতলের মুখটি বোতলের ভেতরে ঢুকে গেল, অনেকটা যেন বোতলটিই মুখটি শুষে নিল। এর ফলে তার ধারণা হলো বাষ্প কোন বস্তুকে গতিশীল করতে পারে। উৎসাহিত হয়ে তিনি ১৬৯৮ সালে প্রথম একটি খেলনা ইঞ্জিন তৈরী করলেন।
যন্ত্রটিতে চলমান কোন অংশই ছিল না, তার উপর একেবারেই ব্যবহার উপযোগী ছিল না। এরপর অনেকদিন সাভেরী চুপচাপ রইলেন। ১৭০৫ সালে সাভেরী থমাস নিউকোমেন নামের একজন বৃটিশ প্রকৌশলীকে অংশীদার নিয়ে বাষ্পীয় শক্তিসম্পন্ন একটি মেশিন তৈরী করলেন। এটি দিয়ে জল তোলা যেত। একটি নলের ভিতরে বাষ্প জমিয়ে মেশিনটি সচল হতো। বাইরে থাকত একটি পিস্টন, এটি বাষ্পের জোরে সামনে পেছনে চলত। নিউকোমেনের ইঞ্জিন যদিও বাষ্পকে শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল, কিছুটা কাজও দেখাল, এরপরও এটার নড়বড়ে অবস্থা আর সামান্য কার্যক্ষমতা কাউকেই আকৃষ্ট করল না। এ ধরনের অল্প কয়েকটা মাত্র মেশিন তৈরী করা হয়েছিল, কারণ মেশিনটিতে খরচ যা হতো সে তুলনায় এর থেকে কাজ পাওয়া যেত অনেক কম। এরপর আশি বছর কেটে যায়। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আর কোন উন্নয়ন করতে কেউ এগিয়ে এলেন না।
১৭৮৩ সালে জেমস ওয়াট নামের এক ইংরেজ বিজ্ঞানী এ ব্যাপার উৎসাহী হলেন। তিনিই খুঁজতে লাগলেন নিউকোমেনের ইঞ্জিনের দূর্বলতাগুলি কোথায়? তিনি খুঁজে পেলেন তিনটি খুঁত। এবার আবিষ্কারে তিনি মন দিলেন। তিনটি জিনিস তিনি তৈরী করলেন- ফ্লাই হুইল, চাকা ঘোরানোর জন্য স্লাইডিং আর্ম এবং ভাল্ব। এই তিনটি যন্ত্র সংযোজন করতেই নিউকোমেনের ইঞ্জিন কার্যকর হয়ে উঠল। চোঙ্গায় আটক বাষ্প কয়েকটি পিস্টনকে সামনে পেছনে করতে। সহায়তা করছে। এই গতির একটি আনুভূমিক লোহার পাতের সঙ্গে সংযুক্ত, লোহার পাতটি ভারী ফ্লাই হুইলটি ঘুরিয়ে দেয়। ফ্লাই হুইলের ভরবেগ শুধু পিস্টনকেই চালায় না, এটা একটি নিদ্দিষ্ট বিরতিতে বাষ্পকে নলে ঢুকতে বের হতে সাহায্যও করে; তার উপর এর সাহায্যে শক্তিকে যান্ত্রিক সুবিধায় পরিণত করা যায়। বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে অনেক কাজে ব্যবহার করা হলো, কিন্তু জেমস ওয়াটের কখনো মনে হয়নি রেলগাড়ীতে এ ইঞ্জিন ব্যবহার করা যায়। অবশ্য সেকালে রেলগাড়ীরই ধারণা লোকের ছিল না। ওয়াটের ইঞ্জিন সবসময় একটি জায়গায় বসিয়ে ব্যবহার করা হতো, কিন্তু গতিশীল বাহনে ব্যবহার করার সবগুণই তার ইঞ্জিনে ছিল।
জেমস ওয়াটকে প্রথম বারের মতো কার্যক্ষম বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হলো। তিনিই উনবিংশ শতাব্দীকে বাষ্পীয় যুগে ঠেলে দিলেন। যদিও গতিশীল বাহন তিনি আবিষ্কার করেননি কিন্তু তিনি ছিলেন এই কাজে অগ্রদূত, তার এই বিস্ময়কর আবিষ্কার পরবর্তী একশো বছরেরই বেশী সময় আমেরিকার মূল যানবাহন হিসেবে গণ্য হতো। যতদূত জানা যায় স্বয়ংক্রিয় যান প্রথম তৈরী করেন একজন ফরাসী সেনা ক্যাপ্টেন। নিকোলাস জোসেফ কুগনোট নামের এই ক্যাপ্টেন ভারী মালামাল আনা নেয়ার জন্য ১৭৬৯ সালে স্বয়ংক্রিয় গাড়ীর ডিজাইন করেছিলেন। সেই গাড়ীটি ছিল তিন চাকার, উপরে থাকত বিশাল ভারী একটি বয়লার ও ইঞ্জিন। গাড়ীটি দেখতে বিদঘুটে আর চলার সময় দিক পরিবর্তনের দরকার হলে ইঞ্জিন ও বয়লার ঘুরিয়ে বসিয়ে তা করতে হতো।
মালামাল পরিবহনের কাজে যদিও এর ব্যবহারিক গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিন। কুগনোটের আবিষ্কারের বিশ বছর পর অলিভার ইভান্স নামের একজন মেকানিক স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। তাকেই স্বয়ংক্রিয় গাড়ীর আবিষ্কর্তা হিসেবে মেনে নেয়া হয়। ইভান্সের গাড়ী অনেকটা নৌকার মতো দেখতে। এটির গতি ছিল আমাদের হাঁটার গতির মতো। লোকে এই গাড়ী দেখে মজা পেত, কিন্তু লোক-চলাচলের কাজে এর কোন মূল্য ছিল না। একবার কোন কারণে ইভান্স তার অদ্ভুত যন্ত্রের কিছু ড্রয়িং ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়েছিলেন। হঠাৎ করে ড্রয়িংগুলো রিচার্ড ট্রেভেথিক নামের প্রতিভাবান একজন প্রকৌশলীর হাতে পড়ে যায়।
বন্ধুরা রিচার্ডকে "ক্যাপ্টেন ডিক" নামে ডাকতো। সেটা ১৮০১ সালের কথা। ড্রয়িংগুলো হাতে পেয়ে ক্যাপ্টেন ডিক স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিনের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে, ইভান্সের ভুলগুলোকে শোধরানোর জন্য নিজের কিছু আবিষ্কার তাতে সংযোজন করলেন। তৈরী হয়ে গেল প্রথম কার্যকর মালবাহী বাষ্পীয় ইঞ্জিন। ঘণ্টায় এটা পনের মাইল দৌড়াতে পারত। আজকের দিনে ক্যাপ্টেন ডিকের ইঞ্জিন হয়তো কিছুই না মনে হতে পারে, কিন্তু সেকালে এটা ছিল অত্যাধুনিক, এটা মাঝামাঝি দূরত্বে মানুষজনকে আনা নেয়া করত। সেকালে ডিকের গাড়ীকে লোকে বলত, "ঘোড়া ছাড়া গাড়ী"। এই ঘোড়া ছাড়া গাড়ীর আবিষ্কার ছাড়াও ক্যাপ্টেন ডিক দুটো সমান্তরাল পাতের উপর দিয়ে চলার উপযোগী বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরী করলেন। এই অবিস্মরণীয় কীর্তির জন্য তাকে লোকোমোটিভের বা রেলগাড়ীর জন্মদাতা হিসাবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। আজকের দিনের রেল পরিবহনের বিশাল বিস্তৃতি, এই মহান আবিষ্কর্তার অনলস শ্রম ও প্রতিভার ফসল। ক্যাপ্টেন ডিকের আবিষ্কারের তিন বছর পর জন ব্লেনকিনশপ স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলেন। শক্তির উৎস হিসাবে কয়লাকে তিনিই প্রথম ব্যবহার করলেন।
ব্লেনকিনশপের পদ্ধতি অনুসরণ করে কিছু নতুন উদ্ভাবনা জুড়ে দিয়ে আরও অনেকে স্বয়ংক্রিয় লোকোমোটিভ তৈরী করলেন। তবে এদের কারও আবিষ্কারই তেমন সাড়া ফেলেনি। অবশেষে ১৮১৫ সালে জর্জ স্টিফেনসন যে ইঞ্জিনটি আবিষ্কার করেন, সেই ইঞ্জিনটিই উন্নয়ন সাধন করতে করতে আজকের রেল ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে। ১৮২৫ সালে পৃথিবীতে প্রথম বারের মতো লোক-চলাচলের জন্য যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা চালু হয় ইংল্যাণ্ডে।